হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অন্তত তিন শতাংশ আর ক্ষয় রোগে আক্রান্ত এবং পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ো দুর্বল হবে একে থামিয়ে রাখার জন্য কোন ওষুধ বা উপায় আবিষ্কার হয়নি। তবে চেষ্টা করলে হাড়ের এই ক্ষয় রোধের গতি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
হাড়ের দুটি অংশ থাকে অপরের শক্ত আবরণটিকে বলা হয় কম্প্যাক্ট বোন। এবং ভেতরের স্পঞ্জের মত ছিদ্র ছিদ্র করা স্তরটিকে বলা হয় স্পঞ্জি বোন। আমাদের আর্টিকেলের আজকের এই পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো হার ক্ষয় হওয়ার কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে।
হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণঃ
হাড় ক্ষয় হওয়ার প্রধান কারণ হলো বংশগত কারণ, এছাড়াও ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অভাবে ধূমপান ও মদ্যপান ইত্যাদি এগুলো হাড় ক্ষয় হওয়ার প্রধান কারণ। এগুলো বাদেও জোকৃতের রোগ, রিউমাটইয়েড অথ্রাইটিস, ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ, দীর্ঘদিন ষ্টোর অ্যাড ব্যবহার ইত্যাদিও হাড়ের ক্ষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৫০ বা তার বেশি বয়সের প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজনের এই রোগের কারণে হাড় ফাটে। উপরে উল্লেখিত সকল সম্ভাব্য কারণ এর মধ্যে সবচাইতে ভয়ানক কারণ হলো ইস্ট্রোজেন অথবা হর মনের অভাব। যা নারীদের ক্ষেত্রেই হওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ নারীরা এ রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। এছাড়াও আরো নানা কারণে হাড় ক্ষয় হতে পারে আপনার চলুন নিম্নে জেনে নেওয়া যাক হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণগুলো।
- আপনি যদি কোমল পানির প্রতি আসক্ত হন তবে আপনার ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ তরল খাবার খেতে অরুচি ভাব চলে আসবে এবং এটা থেকেই আপনার হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়াবে।
- আপনি যদি উচ্চ পরিমাণে অ্যালকোহল পান করেন তবে উচ্চ পরিমাণে অ্যালকোহল পান করার ফলে স্ট্রোজেনে মাত্রা কমে যায় যার কারণে আপনার হাড় ক্ষয় হতে পারে।
- আর হল জীবন্ত কলা বা লিভিং টিস্যু যা ভারের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। আপনি হারকে যত বেশি ব্যবহার করবেন তত বেশি খাপ খাওয়াতে পারবে ও মজবুত হবে অন্যদিকে হার কে ব্যবহার না করলে হাড়ের ক্ষয় হতে থাকবে আপনার। সেজন্য আপনি যদি দীর্ঘ সময় বসে থাকেন তবে আপনার হাড় ক্ষয়ে প্রবণতা বেড়ে যাবে।
- হাড় ক্ষয় থেকে আপনি যদি পরিত্রাণ পেতে চান তবে একটি উত্তম উপায় হলো নিয়মিত হাটা।
- যারা প্রচুর পরিমাণে মাংস খান তাদেরও হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে কারণ উচ্চ প্রোটিন এর খাবার খেলে কিডনিগুলো শরীর থেকে বেশি করে ক্যালসিয়াম বের করে দেয় আর এই ক্যালসিয়াম হচ্ছে হার গঠনের অন্যতম প্রধান উপকরণ বলে এটি কমে গেলে হারের খনিজ ঘনত্ব কমে যায়। সেজন্য উচ্চ প্রোটিনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- চল্লিশ দিয়ে যেসব নারী উচ্চ পরিমাণে লব ণ খেতে থাকেন তাদের মধ্যে ফ্র্যাকচারের হার লবণের অনাসক্ত নারীদের তুলনায় চার গুণ বেশি। সেজন্য শেষ বয়সে হাড়ের সমস্যায় জর্জরিত হতে না চাইলে আপনি কতটুকু লবণ খাচ্ছেন সেদিকে খেয়াল রাখুন। আপনি প্রতিদিন ২,৩০০ মিলি গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কারণ এর চেয়ে বেশি লবণ খেলে আপনার আর ক্ষয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে কারণ উচ্চ লবণ গ্রহণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।
- আপনি যদি হাড় ক্ষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চান তবে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে পারেন। এটা ঠিক যে তোকে ক্যান্সারের ঝুকে আড়ালে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত কিন্তু তাই বলে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে শরীরে ক্যালসিয়ামের কাজে সহায়তার জন্য ভিটামিন ডি এরও প্রয়োজন রয়েছে। আপনার বয়স যদি ৫০ পার হয় তবে প্রয়োজনে ৮০০ থেকে ১০০০ আইইউ হয় কিছু সময় রোদে কাটিয়ে শরীরকে ভিটামিন ডি তৈরির সুযোগ দিতে পারেন আপনি। আপনার যদি রোদে কাটানোর মত সময় না থাকে তবে আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট শ্রবণ করতে পারেন।
হাড় ক্ষয় হওয়ার লক্ষণঃ
হাড় ক্ষয় হওয়া বেশিরভাগ রোগী প্রথমবার হার ফেটে না যাওয়া পর্যন্ত কোন লক্ষণই বোঝা যায় না। আর এ রোগের সাধারণত মেরুদন্ড হাতের কব্জি হাড়ের সবচাইতে বেশি ফাটল ধরে। সেজন্য আপনার হাড় ক্ষয় হওয়ার রোগ হয়েছে কিনা তা বোঝা যাবে বোন মিনারেল ডেন সিটি টেস্ট করার মাধ্যমে।
ডেনসিটি টেস্ট পরীক্ষার সময় লাগে কম ব্যথাহীন এবং নিরাপদ একটি পরীক্ষা। আপনি চাইলে এ পরীক্ষাটা করতে পারেন কারণ এই পরীক্ষায় হারের ঘনত্ব কম কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া আজ অন্য কোন কারণেও হাড়ের ক্ষয় হচ্ছে কিনা তা জানার জন্য রক্ত ও মুত্র পরীক্ষা করা হয় আপনার। অতএব আপনার যদি হাড় ক্ষয়ের রোগ হয়ে থাকে তবে অবশ্যই ডেন সিটি টেস্ট করাবেন।
আর ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত যতটুকু আঘাতে একজন ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গার কথা তার মাত্র এক পঞ্চমাংশ আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। আর মেরুদন্ডের হাড়ের ক্ষয় হলে মানুষ একটা পর্যায়ে গিয়ে পুজো হয়ে যায় মেরুদণ্ড ছাড়াও কোমর হাতের কব্জি পায়ের ক্ষয় হবার প্রবণতা অনেক বেশি। আসলে যেসব হার মানুষের শরীরে ওজন বহন করে সেগুলো হয় বা ভেঙ্গে যায় এর উক্তির কারনে।
হাড় ক্ষয় হওয়ার চিকিৎসাঃ
মানুষের হাড় সবচেয়ে বেশি মজবুত থাকে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এরপর থেকে হাড় দুর্বল হতে শুরু করে। মূলত আপনার যখন বয়স বাড়বে তখন আপনার হাড় দুর্বল হতে থাকবে যা বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক বিষয় তবে কিছু মানুষের এই হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়।
আর সাধারণত একদিকে ক্ষয় হতে থাকে এবং অপরদিকে গঠন হতে থাকে। যদি ক্ষয় হওয়ার গতি নতুন হাড় গঠন হওয়ার গতির চাইতে কমে যায় হাড় শুরু হয়। আপনি যখন দেখছেন আপনার হারে বেশি ছিদ্র হয়ে গেছে তখনই আপনার হারের ঘনত্ব কমে যাবে। এতে করে আপনার হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে ফলে সহজেই হাড় ভেঙে যাওয়া বা ফ্যাকচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে আপনার হাড়ের। চলুন নিম্নে জেনে নেই হাড় ক্ষয় হওয়ার রোধে কয়েকটি উপায় তুলে ধরা হলো-
- হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণে যদি আপনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তবে চিকিৎসকরা সাধারণত ক্যালসিয়ামের জন্য নিয়মিতভাবে আপনাকে মাছ মাংস ডিম দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকার কথা বলবেন।
- এছাড়াও সামুদ্রিক মাছ খাওয়া ধূমপান ত্যাগ করা এবং ডায়াবেটিস লিভার কিডনি রোগ থাকলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দেবেন।
- এবং আপনাকে সতর্কতা হিসেবে বাসা তে বাথরুমের পিচ্ছিল ভাব দূর করা রাতে ঘরে মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখা এবং অন্ধকারে চলাফেরা না করার কথা বলবেন। এবং আপনাকে এগুলোর পাশাপাশি এ রোগে যারা আক্রান্ত হন তাদের কোন ভাবে অতিরিক্ত ওজন বহন না করার কথাও বলা হয়।
হাড় ক্ষয় হওয়ার প্রতিকারঃ
আপনি যদি আর ক্ষয় রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখাটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য আপনাকে শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ভিটামিন বিও প্রোটিন সরবরাহ করতে হবে। সঙ্গে আপনাকে খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি তবে আপনি হাড় ক্ষয় হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
আপনি যদি হাড় ক্ষয় হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে চান তবে অবশ্যই আপনাকে ধূমপান ও মধ্য পান পরিত্যাগ করতে হবে। এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খেতে হবে আপনাকে। এই ক্যালসিয়ামের আদর্শ উৎস হচ্ছে দধ। তবে আপনি চাইলে আরো অনেক খাবার থেকে ক্যালসিয়াম যোগান দিতে পারবেন।
আর ক্ষয় প্রতিরোধ করতে হলে আপনাকে নিয়মিত শরীর চর্চা করতে হবে। এছাড়াও হাড় ক্ষয় রোধ করতে ভিটামিন ডি গ্রহণের পাশাপাশি দুগ্ধজাত খাবার এবং দুধ খেলে মেরুদন্ডের খনিজের ঘনত্ব বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। দুগ্ধ যত খাবারের মধ্যে রয়েছে দই, ক্রিম, পনির ইত্যাদি।
উপসংহারঃ হাড় ক্ষয় হওয়ার কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার
পরিশেষে আমি বলতে চাই যে, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশই হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। এবং এ রোগে নারীরাই ভেসে আক্রান্ত হয়। এছাড়া এ রোগে আক্রান্তদের অনেকেই তাদের রোগ সম্পর্কে জানেন না এবং আক্রান্তদের সম্ভবত সঠিক চিকিৎসা না হলে এমন কি ছয় মাসের মধ্যেই মৃত্যু ঘটতে পারে।
এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থেকে ধৈর্য সহকারে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের আজকের আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হন, তবে আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন এবং আরো নতুন কোন তথ্যর জন্য আমাদের ওয়েবসাইটি ভিজিট করুন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url