পোড়াদহ মেলার ইতিহাস এবং বগুড়ায় ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলা

আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আমাদের আজকের আটে গেলে আমরা আপনাদের জানাবো পোড়াদহ মেলার ইতিহাস এবং বগুড়ায় ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলা সম্পর্কে। বাংলাদেশের গ্রামের মেলা সমূহের মধ্যে বগুড়ার পোড়াদহ মেলা অন্যতম। মেলাটি প্রায়ই চারশত বছর পূর্বে শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়।

পোড়াদহ মেলা বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের একটি প্রাচীন লোকজ মেলা। বগুড়া জেলা শহর হতে ১১ কিলোমিটার পূর্ব দিকে ইচ্ছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ নামক স্থানে পোড়াদহ মেলা নামে পরিচিত। পোড়াদহ মেলা প্রতিবছর একবার বসে।

ভূমিকাঃ

পোড়াদহ মেলার শুরুর সঠিক সাল জানা যায় না তবে বলা হয় বর্তমান সময় থেকে প্রায় চার শত বছর পূর্বে কোন এক সময়ে মেলা সংগঠিত হয়েছিল এই অঞ্চলে। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ইচ্ছামতী নদী সংলগ্ন মাঠে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ঐতিহ্যবাহী এই মেলার আয়োজন হয়। বর্তমানে যেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে একটি বট বৃক্ষ ছিল। 

লোকমুখে শোনা যায় একদিন হঠাৎ করে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয় বট বৃক্ষের নিচে তারপরে সেখানে দলে দলে সন্ন্যাসীরা এসে একটি আশ্রম তৈরি করেন সেই নিচে। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে সেটি একটি পূর্ণ স্থানে পরিণত হয় এবং মাসের শেষ দিনের কাছে বুধবার সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করা হয় এবং দূর প্রান্ত থেকে ভক্তরা প্রতিবছর সেই দিনটিতে এসে সমাগত হতে থাকে। 

দিন গড়ানোর সাথে সাথে প্রতিবছর সেখানে লোকসমাগম বাড়তে থাকে এবং একসময় সেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সন্ন্যাসীরা সেখান থেকে চলে যায় কিন্তু পূজাটি অব্যাহত থাকে ধীরে ধীরে মেলাটি পরিচিতি বাড়তে থাকে এবং দূর প্রান্ত থেকে মেলা দেখতে লোকজন আসে। পূজা-পার্বণ মূলত হিন্দুদের হলেও হিন্দু ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সব ধর্মের মানুষকে উৎসবে একত্রিত করে। 

এবছর মেলায় সবচেয়ে বড় ব্ল্যাক কাপ মাছটির ওজন ছিল ৪০ কেজি। এছাড়া ১০ থেকে ২০ কেজি ওজনের রুই কাতলা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠেছে মেলায়।

পোড়াদহ মেলার নামকরণের ইতিহাসঃ

পোড়াদহ মেলা যেহেতু সন্ন্যাসীদের দিয়ে শুরু হয়েছিল সেজন্য এই মেলার নাম ছিল সন্ন্যাসী মেলা। এরপরে মেলাটি পোড়াদহ নামক স্থানের সংঘটিত হয় বলে লোকমুখে স্থানের নাম অনুসারে পোড়াদহ মেলা হিসেবে চলতে চলতে একসময় এর নাম পোড়াদহ মেলা হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়।

মেলা উপলক্ষে গ্রামের যেসব মেয়েদের বিয়ে হয়েছে তারা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি জামাই নিয়ে বেড়াতে আসায় এই মেলাতে জামাই মেলা হিসেবেও সম্বোধন করেন। এই মেলায় নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় বলে একে মাছের মেলাও বলা হয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন নামে সম্বোধন করলেও এটি মূল্যত পোড়াদহ মেলা নামে সবার কাছে পরিচিত।

পোড়াদহ মেলার সময়কালঃ

পোড়াদহ মেলা অনুষ্ঠিত হয় মূলত প্রতিবছর বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ তিন দিনের মধ্যে আগত বুধবারে আয়োজিত হয়। এদিনে দূর দূরান্তের মানুষ মেলায় আসে তবে একদিনের মেলা হলেও স্থায়ীভাবে সপ্তাহব্যাপী উৎসব লেগে থাকে। মেলাও উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা এসে জড়ো হয় চারিদিকে উৎসবমুখর অবস্থা তৈরি হয়। 

মুল মেলার পরদিন বৃহস্পতিবার একই স্থানে এবং আশপাশের গ্রামে গ্রামে চলে ছোট আকারে বউ মেলা। মূল মেলাটি সরকারি তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হলেও বউ মেলা স্থায়ী গ্রামবাসীর উদ্যোগে আয়োজন করা হয় গ্রামের যেসব মহিলা কাজের চাপে অথবা সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে মূল মেলায় যেতে পারেন না তাদের জন্যই বিশেষ করে এই আয়োজন করা হয়। 

বউ মেলার একটি বিশেষত্ব হলো এখানে বিবাহিত এবং অবিবাহিত নারীরা প্রবেশ করতে এবং কেনাকাটা করতে পারেন। কিন্তু জামাই মেলা বা পোড়াদহ মেলায় বিবাহিতরা ছাড়া অবিবাহিতরা সেখানে কেনাকাটা করতে পারে না।

পোড়াদহ মেলার কেনাকাটাঃ

পোড়াদহ মেলা শুরু হওয়ার সাথে সাথে নানারকম আসবাবপত্র, খাদ্য, কসমেটিক্স, মিষ্টি, খাবারের দোকান, অন্যান্য পণ্যের দোকান বসে। চলুন নিম্নে জেনে নেই কি কি দোকান এখানে দেখা যায়-

মাছঃ

পোড়াদহ মেলার প্রধান আকর্ষণ হল মাছ এমেলাই পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় মাছ। যেগুলোর ওজন হয় দুই মন থেকে আড়াই মন পর্যন্ত। এছাড়াও এখানে ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের রুই কাতলা পাঙ্গাস মাছ পাওয়া যায়। এবেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাছ ব্যবসায়ীরা তাদের মাছগুলো সেখানে বেচার জন্য নিয়ে যায়। 

ঐতিহ্যবাহী এই একদিনের মেলায় ৫ থেকে ৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এখানকার কে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এখানকার জামাই। কারণ এখানকার জামাইদের মেলা আসলেই শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে এসে তাদের হাতে কিছু টাকা গিফট করা হয় এ টাকা দিয়ে জামাইরা মেলায় মাছ কেনার প্রতিযোগিতায় নামেন। 

বিগত কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে মাছের জন্য আরবিখ্যাত হয়ে উঠেছে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। এখানকার স্থানীয়রা জানান মেলার শুরুটা ছিল কাঠের আসবাবপত্রের বেচাকেনা দিয়ে কিন্তু কাল ক্রমে সেই স্থান দখল করেছে মাছ। স্থানীয়রা মেলা ঈদের উৎসবের মতোই পালন করে থাকেন।

খাবারের দোকানঃ

পোড়াদহ মেলায় যে লোকজন আসে তাদের খাওয়ার জন্য বসানো হয় অস্থায়ী অনেকগুলো হোটেল। এই হোটেল গুলোতে পাওয়া যায়- চটপটি, ভাজাপোড়া, এবং ভাত মাছ, মাংস, আইসক্রিম ইত্যাদি। আপনি যদি এই মেলায় ঘুরতে যান তবে এই হোটেল গুলোতে আপনি যে ধরনের খাদ্য খেতে চান সবগুলোই পাবেন।

আসবাবপত্রঃ

পোড়াদহ মেলায় কাঠের স্টিল ও লোহার বিভিন্ন ডিজাইনের আসবাবপত্র যেগুলো অনেক সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। আপনি আপনার সাধ্য অনুযায়ী যেকোনো ধরনের আসবাবপত্র কিনতে পারবেন এ মেলা থেকে।

কসমেটিক্সঃ

মেলায় বিভিন্ন জেলা হতে লোকজন উন্নত মানের কসমেটিক্স খেলনা গিফট সামগ্রী এর দোকান দেয়। সাধারণত শিশু এবং মহিলাদের ভিড় লেগে থাকে এসব দোকানগুলোতে।

মিষ্টিঃ

পোড়াদহ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হল মিষ্টি। সন্দেশ জিলাপি নিমকি রসগোল্লা তিলের লাড়ু খই শুকনা মিষ্টি। এছাড়াও আকর্ষণীয় হলো বড় বড় আকারের মিষ্টি যেগুলো ওজনের ২০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত হয়।

অন্যান্যঃ

পোড়াদহ মেলা উপলক্ষে দৈনন্দিন জিনিসের বাজার বসে এখানে। মাংস, কাঁচাবাজার, মসলা, গৃহস্থালির, দৈনন্দিন জিনিসপত্র যেমন ছুরি, দা ,বটী এগুলো পাওয়া যায় মেলায়। এক কথায় দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় জিনিসপত্র এ মেলায় পাওয়া যায়।

জামাই মেলার পরে বউ মেলাঃ

পোড়াদহ মেলা অথবা জামাই মেলার পরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পশ্চিম মহিষাবান ইউনিয়নের ইচ্ছামতী নদীর তীরে ৩০ বছর ধরে বউ মেলার আয়োজন করা হয়। অন্যান্য বারের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ বৃহস্পতিবার এ মেলা বসে। নারীদের জন্য বসা এ মেলার নাম বউ মেলা। 

গ্রামের মাঠে বসে জমজমাট এই বউ মেলা মেলায় রেশমি চুড়ি আলতা চিরনি হাড়ি পাতিল ক্রান্তি করায় পানের বাটা সহ হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজান বিক্রেতারা। ক্রেতারা বলতে সবাই নারী কারণ এ মেলায় পুরুষ প্রবেশ করা নিষিদ্ধ তবে দোকানদারের মধ্যে কেউ কেউ পুরুষ থাকে। 

এই মেলার আয়োজকরা বলেন বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ইচ্ছামতী নদীর তীরে বসে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ জামাই মেলা। মেলায় বড় বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া এলাকার শত বছরের রেওয়াজ। মেলাও উপলক্ষে আশপাশের গ্রামগুলোর বউয়ের বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। 

পোড়াদহ মেলায় লাখ মানুষের ভিড়ের কারণে মেয়েরা মেলায় আসতে পারে না। এজন্য প্রায় তিন দশক ধরে জামাই মেলার একদিন পর ত্রিমোহনী গ্রামে নারীদের জন্য বউ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। গ্রামের নারীরা মেলায় বেশি আসেন বলে এটি বউমেলা নামে পরিচত।

উপসংহারঃ পোড়াদহ মেলার ইতিহাস এবং বগুড়ায় ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলা

পরিশেষে আমি বলতে চাই যে, বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার পূর্ব বগুড়ার গাবতলীর ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ বা জামাই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২৪। প্রাচীন এ মেলাই অংশ নিতে আয়োজক ও ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত সময় পার করেছেন। প্রিয় পাঠক বন্ধুরা,আপনারা যারা এতক্ষণ ধৈর্য সহকারে আমাদের আর্টিকেলটি পড়েছেন তাদেরকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। 

আমাদের আজকের আর্টিকেলটি যারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন পোড়াদহ মেলার ইতিহাস এবং বগুড়ায় ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলা সম্পর্কে। আমাদের আজকের আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হন তবে আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন এবং এরকম আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url